A nice love story


                        A nice love story in Bengali


ঘরে ঢুকে পল্লব দেখল শুকনো মুখে সুরভি খাটের ওপর বসে আছে। একপ্রস্থ নিজেকে তৈরি করে একটুখানি গলা খাঁকারি দিয়ে সে বলেই ফেলল-" এটা কি করে হলো?"
মাথা তুলে সুরভি জানাল- " ফুড পয়েজিনিং"
- " মানে, সেটা থেকে বাচ্চা হয় কিভাবে?"
-" আমার মাথায় দেখি গোবর পোরা আছে। কাল যে বান্ধবীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম , ওরসাথে রেস্টুরেন্টে একপ্লেট বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ সাঁটিয়ে ছিলাম। তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে আবার ফুচকাও খেয়েছিলাম"
-" কিইইই? আপনি দেখছি কুম্ভকর্ণ হবার সাথে সাথে লেডি রাক্ষসও। এইটুকু চেহারা হলে কি হবে, খাওয়ার বেলা আপনি বাঘের সমিতিকেও হার মানাবেন"
-" আপনি একটা মানুষকে খাবার খোঁটা দিচ্ছেন। এমনিতে সকাল থেকে বমি হচ্ছে। শরীর খুব খারাপ। এসব দেখে মা ভাবতে লাগল আমি প্রেগনেন্ট। আমি যতো বোঝানোর চেষ্টা করছি ততই উনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে সব আত্মীয়দের একে একে ফোন করে যাচ্ছেন।"
-" উফ মাকে নিয়ে আর পারা যায় না। যাইহোক এবারে তো ওদের ভুলটা ভাঙাতে হবে। নাহলে একফোঁটা জল সমুদ্রে পরিণত হবে"
-" মানে?"
-" মানে আর আপনাকে বুঝতে হবে না। চলুন আগে আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। তারপর মা পিসিদের আনন্দ ভঙ্গ করছি। মাইরি বলছি যখন শুনলাম আমি বাবা হতে চলেছি তখন মনে হচ্ছিল আমার হৃতপিন্ডটাকে নিয়ে কেউ হকি খেলছে। যাকবাবা এবারের মতো আমার মান সম্মানটা বেঁচে গেল...কি ব অ অ..."- সুরভি ততক্ষণে পুরো কথা না শুনেই আরো একপরন বমি করতে বাতরুমে ছুটেছে...

এরপর ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর সবার কাছে সত্যিটা মিনারেল ওয়াটারের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। মা পিসিদের এই আঘাতটা সামলাতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল। তাও তারা আশা ছাড়েননি। কোনো একদিন তো ওদের সবার মনবাঞ্ছনা পূর্ণ হবেই।

সেদিন ছিল ঝড়ের এক রাত। দরজা জানলা সব উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছিল। বাড়িতে শুধু পল্লব আর সুরভি ছিল। বাবা মা মেজো মাসির বাড়ি গিয়েছিল। সুরভি রান্নাঘরে ছিল, ঝড়ের বিকট আওয়াজ শুনে ছুট্টে আসে ঘরে। এসে দেখে পল্লবের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেয়, সারা ঘর ধূলোমাখা হয়ে গেছে তাও খাটের উপর বসে সে মোবাইলে ব্যস্ত। খানিকটা বিরক্ত হয়েই সুরভি জানালাগুলো বন্ধ করতে গেলো কিন্তু কিছুতেই বাগে আনতে পারছিল না। হঠাত্‌ একটা হাতের ছোঁয়ায় তাকিয়ে দেখল পল্লব ওকে সাহায্য করতে এসেছে। আজ আর ছোঁয়াটা অচেনা লাগল না, বড্ড আপন লাগল। হয়তো একসাথে থাকায় একপ্রকার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। খানিকক্ষণ বিরতি দিয়ে লজ্জা পেয়ে সুরভি জানালা ছেড়ে পিছিয়ে আসে। পল্লব জানালাগুলো শক্ত করে লাগিয়ে দিয়ে খোঁটা দেয়-" এতো যে খাবার খাচ্ছো, কোথায় যায় সেইসব, গায়ে একটুকু জোর নেয়"
নাক সিটকে সুরভিও উত্তর দেয়-" আপনার থেকে কমই খায়, আপনার গায়েই শক্তি, মাথায় বুদ্ধি কম"
-" এই এই খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু..."
-" উঃ বাবা গো"- বলেই চেঁচিয়ে পল্লবকে জড়িয়ে ধরল সুরভি। কাছেপিঠেই কোথাও বাজ পরল মনে হয়। ভয়ে আতঙ্কে সুরভি আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় পল্লবকে। এই প্রথমবার সে পল্লবের এতো কাছে গেলো। নিজের অজান্তেই বড্ড আপন করে নেয় পল্লবকে সে। কিছুক্ষন নিশ্বব্দে কাটার পর সুরভির হুশ ফিরে আসে। নিজের কর্মকান্ডে লজ্জিত হয়ে মাথা নীচু করে থাকে। পল্লব পরিবেশটাকে স্বাভাবিক করার জন্য বলে উঠল-" খুব ভয় করছে বুঝি"
-" না ঠিক আছে এখন"
আবারো খানিক নীরবতা...
-" বলছিলাম সুরভি, আমরা বন্ধু হতে পারিনা? রোজ ঝগড়া করতে আমারো ভালো লাগে না। হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। তোমার কি মনে হয়?"
-" আমিও, আমিও হাঁপিয়ে উঠেছি বিশ্বাস করুন। এবাড়িতে সবাই খুব ভালো তাও একজন বন্ধুর অভাব সমসময় বোধ করি। হবেন আমার বন্ধু?"
-" একটা শর্তে!"
-" বন্ধুত্বেও শর্ত?"
-" আহা শোনোই না।"
-" বেশ বলুন।"
-" আজ থেকে আর আপনি নয়, শুধু তুমি।"
-" আচ্ছা তাই হবে।"

আমাদের আরও সুন্দর সুন্দর গল্প ও কবিতা পড়তে এখানে ক্লিক করুন 
যদি আমাদের সাথে শেয়ার করতে চান তো এখানে ক্লিক করুন

সেদিন রাতে এইভাবেই বহু দূরত্বে থাকা প্রান বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। উপরওয়ালা হয়তো মুচকি হেসেছিলেন। তারই সৃষ্ট সবকিছু, এ দুনিয়ার সব সম্পর্ক যে তারই তৈরি করা। ধীরে ধীরে পল্লব আর সুরভির মধ্যে সমীকরণটা অনেক সোজা হয়ে গিয়েছিল। ওরা একে ওপরের বন্ধু হয়ে উঠছিল। সকালবেলা সুরভিই আগে পল্লবকে বাতরুম ছেড়ে দেয়। তারপর নিজে স্নান ছেড়ে রান্নাঘরে যায় নিজের হাতে পল্লবের জন্য রান্না করতে। পল্লবের পছন্দ মতো খাবার বানায়। যত্ন করে পরিবেশনও করে। পল্লব অফিস থেকে ফেরার পর সুরভি সারাদিনের টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলো গল্পের ছলে বলতে থাকে ওকে। সময় কখন পেরিয়ে যায় দুজনের কেউই টেঁর পায়না। পল্লব আবার সুরভির সময় কাটানোর জন্য ওর কিছু প্রিয় লেখকদের উপন্যাস আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের অ্যালবাম নিয়ে আসে। সুরভির সারাটাদিন বেশ ব্যস্ততায় কেটে যায়, মনের মলিনতা কেটে এক সুস্থ সুন্দর জীবন কাটাতে শুরু করেছে এখন সে...

সেদিন সকাল থেকেই ছিল মেঘলা আকাশ। বৃষ্টিস্নাত চারিদিক। গোমড়ামুখো মেঘটা অঝোরে কেঁদেই চলেছে। পল্লব বৃষ্টি মাথায় করেই অফিসে ছুটল সেদিন, অফিসে না গেলেও না ,ভীষণ জরুরী মিটিং ছিল ক্লাইন্টের সাথে। পল্লব বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পরই সুরভি একলা জানালার ধারে মাথা ঠেকিয়ে বসে। এখন যে তার মুক্ত অবসর। বইয়ের পাতায় উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সাথে সখ্যতা করার সময়। এই পুরো সময়টা তার একান্ত বড্ড আপন। কি মনে হলো হোম থিয়েটারে সুরভি তার প্রিয় গানটা চালিয়ে গ্রীলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে গুনগুনিয়ে উঠল-

"ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো-- তোমার
 মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
 তাহার তালটি শিখো-- তোমার
চরণমঞ্জীরে॥
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি-- তোমার
 প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥"

সমস্ত আকাশ বাতাস সিক্ত হলো সেই সুরে। সুরভি দেহ মন শিহরিত হয়ে উঠল কোনো এক অজানা পুলকে। তার প্রিয় বন্ধুটি এখন কি করছে কে জানে? বৃষ্টিতে ভিজে আবার ঠান্ডা না লাগায়? কপালে ভাঁজ আসে সুরভির। এইভাবেই কেটে যায় পুরো দিনটা। সন্ধেবেলা অফিস থেকে বেরোনোর আগে পল্লব সুরভিকে ফোন করে বলে -
-" কি গো কি করছ?"
-" কিছুনা, তুমি কখন আসবে?"
-" আমি এই বেরোচ্ছি। বলছি শোনো আজ আমার সাথে আমার অফিসের এক কলিগও আসবে। তুমি খাবার দাবারের ব্যবস্থা করে রেখো। ওকে আমি ডিনারে ইনভাইট করেছি।"
-" আচ্ছা বেশ, সব হয়ে যাবে, তুমি কোনো চিন্তা করোনা পল্লব।"
-" এই না হলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড"
মুচকি হেসে ফোনটা রেখে দিয়েই সুরভি শ্বাশুড়িমা কে ডিনার ব্যাপারটা জানায়। তারপর আসন্ন অতিথির জন্য রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পরে। এইভাবে কেটে যায় বেশ কিছুটা সময়। সন্ধ্যে ঠিক ৭ টার সময় বেল বাজার শব্দ পেয়েই ছুট্টে যায় সুরভি। নিশ্চয় পল্লব। শ্বাশুড়িমা দরজা খুলে দেন। ভেতরে বসতে বলেন আগন্তুককে। পল্লব সুরভিকে দেখে বলে -" মিট সুরভি, হি ইজ মাই ফ্রেন্ড কাম কলিগ"

সুরভি অনুভব করল ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানকার মাটিটা যেন কেঁপে উঠল। স্মৃতির পাতা বহুবছর পিছিয়ে কিছু সাদা কালো ছবি ভেসে উঠল তাতে। প্রস্ফুটে মনের ভেতরকে কেউ যেন চমকে বলে উঠল-" অনিন্দদা..."

#শেষ_পর্ব

সুরভি নিশ্চল হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। অনিন্দ্য ওরদিকে তাকিয়ে অবাক চোখে বলে ওঠে-" সুরভি তুই এখানে?"
পল্লব কিছু বুঝতে না পেরে বলে-" তুই ওকে চিনিস নাকি অনিন্দ্য?"
-" সেটা তোর বউকেই জিজ্ঞাসা কর। কি বল সুরভি তোকে আমি কিভাবে চিনি?"
সুরভির মুখ থেকে কথা সরে না। সে বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ওকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনিন্দ্য ফের বলে ওঠে-" আরে চিনতে পারছিস না নাকি। আরে পল্লব তোর বউ আমাকে চিনতে পারছে না। ছোট থেকে এক পাড়ায় বড়ো হলাম, ও আমার কাছে পড়তেও আসত, ওর বাড়িতে তো আমার নিত্যদিনের যাওয়াআসা ছিল। তারপর সুরভি যখন ক্লাস এইটে পড়ত আমি তখন এইচ এস দিলাম। তারপর বাবা বদলি হয়ে গেল চুঁচড়ায়। আমরা সব কিছু গুটিয়ে পাটিয়ে চলে গেলাম বাবার সাথে।"
পল্লব জিজ্ঞাসু চোখে সুরভির দিকে তাকিয়ে বলে -" কি গো সুরভি, তুমিতো অনিন্দ্যর কথা আগে কোনোদিন বলো নি?"
-" আরে ওর কি এই অনিন্দ্যের কথা মনে আছে যে তোকে বলবে? ছাড় সেসব কথা, আবার যখন দেখা হলো তখন আর ছাড়ছি না, আমি কিন্তু ভাই এখন প্রায়ই তোর বাড়িতে আড্ডা দিতে চলে আসব। তোর পারমিশন আসে তো?"
-" আরে এতে পারমিশনের কি আছে, তোর যখন ইচ্ছা তখনই এবাড়িতে আসবি।"

সুরভি আর এসবের মধ্যে থাকার শক্তি পায় না। সে রান্না দেখার বাহানায় ছুট্টে বেরিয়ে আসে ওই ঘর থেকে। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। বিছানার উপর লুটিয়ে দেয় নিজেকে। বুকের ভেতরের চাপা কষ্টটা কান্না হয়ে ঝরে পরতে থাকে অবশেষে। পুরনো স্মৃতিগুলো আবার দগদগে ক্ষতোর মতো বেরিয়ে আসে নির্বাসন থেকে। ছোটবেলার সমস্ত কিছু পরিস্কার জলছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। অনিন্দ্য দার ওদের বাড়িতে প্রায়ই আসা, ওর কাছে টিউশানি পড়তে যাওয়া তারপর একদিন সুরভির হাতে হাত রেখে প্রেম নিবেদন সবকিছু মনে পরে যায় ওর। কে আবার ফিরে এলো অনিন্দ্যদা, ওর গোছানো জীবনটা ওলোটপালোট করতে?

সেদিনকার মতো অনিন্দ্য চলে যাবার পর পল্লব আর সুরভির মধ্যে ওদের নিয়ে আর কথা হয়নি কিন্তু সুরভির মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল ওর অতীতটা যদি পল্লবের সামনে চলে আসে তাহলে ওদের মধ্যে গড়ে ওটা এই সুন্দর সহজ সম্পর্কটা কি আর থাকবে? একটা কালো ছায়া যেন ওদের ঘিরে রেখেছে। মাকড়সার পাতে ফাঁদে জড়িয়ে পরছে ও ধীরে ধীরে, দম বন্ধ হয়ে আসছে সুরভির। মুক্তি চায় ও এইসবকিছুর থেকে। বেশতো ভালো ছিল ওরা। কেন ওর জীবনের বইয়ের নষ্ট হয়ে যাওয়া পাতাটা আবার জীবন্ত হয়ে উঠল। সুরভির মনে তখন একটাই চাওয়া পর্নমোচি পাতার মতো এই পাতাটাই যেন অচিরে ঝড়ে পরে ওর জীবন থেকে...

আজকাল সুরভি বড়ো আনমোনা থাকে। কিছু একটার ঘোরে কাটে ওর সারাটাদিন। পল্লবকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কুঁকড়ে থাকে সে সবসময়। এই ভয় শুধুমাত্র একজন বন্ধুকে হারিয়ে ফেলার নাকি, অন্যকিছু।

 সেদিন পল্লব অফিস যাবার পর সুরভি এলোমেলো ঘরটাকে সাজাচ্ছিল সুনিপুণ হাতে। বইয়ের শেলভটা ঘোছাতে ঘোছাতে একটা বইয়ের ভেতর থেকে পল্লবের একটা ছবি পায় সুরভি। ছবিটা হাতে নিয়ে সে আনমনা হয়ে পরে। কত সরজ সরল ভদ্র একটা ছেলে। প্রতিটা মেয়েতো তার স্বপ্নে এমন একটা রাজকুমারকেই কল্পনা করে। বিয়ের প্রথম রাত থেকেই আজ অব্দি কোনদিন সে সুরভির শরীর চায়নি। সুরভির অমতে কোন কাজ করেনি। শুধু দোষের মধ্যে একটু ঝগড়ুটে এই যা। নিজের খেয়ালেই মুখে হাসি চলে আসে সুরভির। অপেক্ষা করতে থাকে পল্লবের জন্য, কখন সে ফিরবে অফিস থেকে...

পল্লব সন্ধ্যাবেলায় অফিস থেকে ফিরলে ওর জন্য চা নিয়ে ঘরে ঢোকে সুরভি। আজ পল্লবের মুখটা অন্যরকম লাগছিল পুরো। কেমন যেনো থমথমে। সুরভি জিজ্ঞাসা করল-" কি হলো তোমার? শরীর খারাপ নাকি?"
-" না কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।"
-" তাহলে তোমার মুখটা এরম লাগছে কেন? কি হয়েছে? মা কে ডাকব? "
-" উফফফ... বলছি না আমার কিছু হয়নি। তুমি এখন যাও এখান থেকে। এমনিতেও তুমি মুক্ত। আমার কাছে থেকে তুমি নিশ্চয় হাঁপিয়ে উঠেছ? যাও যাও চলে যাও, তোমার ভালবাসার মানুষের কাছে।।"
এই প্রথমবার পল্লবের মুখে তিক্ত কথা শুনে সুরভির চোখে জল চলে আসে।
-" আমার ভালবাসার মানুষ! কে সে?"
-" কি নাটকটাই না করতে পার তুমি? জানো না আমি কার কথা বলছি। বলি অনিন্দ্যর সাথে তোমার যখন একটা প্রেমের সম্পর্ক ছিলই তখন আমাকে বিয়ে করলে কেন? অবশ্য এখনো সময় আছে, তোমাকে মুক্তি ছিলাম, যাও যাও চলে যাও।"

সুরভি একবুক কষ্ট নিয়ে কান্নাভেজা চোখে চলে গেলো ঘর থেকে। তারপর সারারাত ও জানালার ধারে বসে কাটিয়েছে। পল্লবের সাথে আর কথা হয়নি ওর। একলহমায় ওদের জীবনটা ছাড়খার হয়ে গেল। আজ অফিসে অনিন্দ্য পল্লবকে আলাদা করে ডেকে সুরভি আর ওর প্রেমের কথা জানায়-" তোকে এসব বলতে তো আমার খুব খারাপ লাগছে তাও বন্ধু হিসেবে সত্যিটা জানানো আমার কর্তব্য। "
-" কি বলতে চাইছিস পরিস্কার করে বল অনিন্দ্য। কোন সত্যির কথা বলছিস তুই।"
-" আমার আর সুরভির মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল আর সেটা প্রেমের সেটা তুই নিশ্চয় জানতিস না। সুরভি আমার কাছে টিউশানি পড়তে আসত সেটা তো তুই জানিসই। তখন থেকেই আমরা একে ওপরকে পছন্দ করতাম। হাতে হাত দিয়ে ঘোরা, সাইকেল করে ওকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, জীবনে একসাথে পথ চলার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমরা। একসাথে স্বপ্ন দেখেছিলাম ঘর বাঁধার কিন্তু একদিন সুরভির বাড়িতে সব জানাজানি হয়ে গেলো। একজন বেকার ছেলের সাথে নিজের মেয়ের জীবনটা জড়াতে চাননি সুরভির বাবা। তাও আমি সুরভির কাছে গিয়েছিলাম , বলেছিলাম চল সুরভি তুমি যদি রাজি থাকো তোমায় নিয়ে অনেকদূর চলে যাবো। সুরভি সেদিন আমাকে সাফ জানিয়ে দেয় আমার সাথে ও পালাতে পারবে না। ওর বাবা যা চায় ও তাইই করবে। একজন বেকার ছেলের সাথে নাকি প্রেম করা যায় কিন্তু বিয়ে করা যায় না। তারপর বাবার সাথে চুঁচড়ায় চলে আসি। ওরসাথে আর যোগাযোগ রাখিনি।"

-" সুরভিতো এইসবের কিছুই জানায়নি আমায়"- পল্লবের চোখে তখনও বিস্ময়...

-" কি করে বলবে। ও একটা লোভি মেয়ে, তোর পয়সা দেখে তোকে বিয়ে করেছে বুঝলি। ও কাউকেই মন থেকে ভালবাসতে পারে না"- আগুনে ঘি দেবার মতো জ্বলে ওঠে পল্লবের দেহমন। বিশ্বাসঘাতকতায় ঝাঁজরা হয়ে ও কান মাথা তপ্ত হয়ে যায় অচিরেই। এতদিন সবকিছুই তবে অভিনয় ছিল? সত্যি মিথ্যা বিচার করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে পল্লব।

পরেরদিন পল্লব অফিস যাবার পরই সুরভি বাড়ি ছেড়ে চলে যায় কাওকে কিছু না বলেই। বাপের বাড়িতেও কিছু জানায় না। সবাই ভাবে কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি ঘুরতে এসেছে। ওদিকে পল্লব দিনদিন খিট্‌খিটে হয়ে যেতে থাকে, কোনো কাজে তার মন বসে না। ওর মাও বুঝতে পারে না ছেলের স্বভাবের আমূল পরিবর্তনের কারণ। ওদিকে সুরভি ঠিক করে সে চাকরির চেষ্টা করবে আর দূরে কোথাও চলে যাবে।। অনেক দূরে কোথাও।।অনেক অভিমানি মন তার। তাদের এতদিনের বন্ধুত্ব তবে মিথ্যে ছিল। সে বন্ধুত্বে বিশ্বাসের ভীতটাই নড়বড়ে সেখানে আর কোনকিছুই অবশিষ্ট থাকে না...

পল্লব অনুভব করে ওর ঘরে কিছু একটা নেয়। এতদিন একটা মানুষ একসাথে থাকলে সে অভ্যাসে পরিণত হয় যে। রাতে ঘুমোনোর সময় আর পাশবালিশটার দরকার পরে না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কেউ আর চাটা এগিয়ে দিয়ে মিষ্টি করে " গুড মর্নিং " বলে না। বইয়ের তাকে উপন্যাসগুলো হয়তো পাঠকের অভাবে নিরবে চোখের জল ফেলে। মনখারাপটা জাঁকিয়ে বসে পল্লবের মনে। শূন্যতা কে ভরিয়ে দেবার জন্য হোম থিয়েটারে গান চালায় সে। গান বেজে ওঠে-

"ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো-- তোমার
 মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
 তাহার তালটি শিখো-- তোমার
চরণমঞ্জীরে॥
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি-- তোমার
 প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥"

ওদিকে পল্লব অফিসে গিয়ে জানতে পারে ম্যানেজমেন্ট কমিটি অনিন্দ্যকে স্যাক করেছে। অফিসের বাকিদের কাজ থেকে সে জানতে পারে অনিন্দ্য নাকি একটা ক্যারেক্টারলেস ছেলে। অফিসের বহু মেয়ের দিকে ওর কুনজর ছিল। সবাইকে নোংরা নোংরা ম্যাসেজেও করত। আজ একজনের সাথে জোর করার সময় সবার হাতে নাতে ধরা পরে। অফিসের সবাই ওকে গনধোলাই দিয়ে বার করে দেয়। পরে ম্যানেজমেন্ট কমিটি থেকে ওকে স্যাক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এইসব জানামাত্রই পল্লবের রাগ হতে থাকে নিজের ওপর। এরম একটা ছেলের কথা বিশ্বাস করে সে সুরভিকে অবিশ্বাস করল? কেন করল অনিন্দ্য এটা জানতেই হবে? পল্লব অনিন্দ্যকে ফোন করে কৈফিয়তের সুরে বলল -" কেন আমাকে মিথ্যে বললি?"
-" সেটা তোর বউকেই জিজ্ঞাসা করিস। "- অনিন্দ্যর সুরে তখনও অনুশোচনার লেশমাত্র নেয়।
-" তোরজন্য আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেলো"
-" সেটাই তো আমি চেয়েছিলাম। তোর বিয়ের পর যখন অফিসের কলিগরা জোর করে তোর ওয়াইভের ছবি দেখতে চাইছিল সেদিন ভীড়ের মাঝে আমিও সুরভির ছবি দেখেই ওকে চিনতে পারি। মনে মনে ছক কষি। তোর সাথে গাঢ় বন্ধুত্ব পাতাই। তারপর তো বাকিটা তোর জানা। আমি যখন সুরভিকে পায়নি তখন আমি কাউকেই পেতে দেবো না... হো হো হো হো"- অট্টহাসিতে ফেটে পরে জানোয়ারটা
-" স্কাউন্ড্রেল"- ফোনটা কেটে যায় তারপর...

এরপর আর এক মুহূর্তও দেরী না করে পল্লব রওনা দেয় সুরভির বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে। জানে মেয়েটা বড্ড অভিমানী। তাও ক্ষমা চাইলে হয়তো আর ফেরাতে পারবে না ওকে।

এখন সামনাসামনি দুটি প্রান। ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা। পল্লবই আগে বলে উঠল-
-" ক্ষমা করা যায়না আমায়"
-" সেদিন তুমি যখন আমায় ওগুলো কটু কথা শোনালে সেদিন আমি নিরব ছিলাম। ভেবেছিলাম যে সম্পর্কে বিশ্বাস নেয় সেই সম্পর্ক এমনিতেই মৃত। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা না করায় ভালো।"
-" অনিন্দ্যর মুখে তোমার সম্বন্ধে ওইসব কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে নিজের অস্তিত্বটাই খুঁইয়ে ফেলেছিলাম তখন। নিজের মধ্যেই ছিলাম না তখন। বিশ্বাস করো আমায়। প্লিজ ক্ষমা করে দাও"
-" তোমরা ছেলেরা কি ভাবো? মেয়েরা খুব অসহায়। পুরুষ ছাড়া তারা অসহায়। না তারা অসহায় নয়। অনিন্দ্য দা ছিল একটা জানোয়ার। আমাকে টিউশনি পরার সময় থেকে ওর আমার উপর কুনজর ছিল। একদিন ও আমায় নোংরা ভাবে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। আমি পড়া ছেড়ে দি। বাড়িতে জানায়। বাবা ওদের বাড়ি গিয়ে ওকে শাসন করেও আসে। তারপর ও এইসবকিছুর বদলা নেবার জন্য একদিন পাড়ার গলিতে আমার সাথে জোর জবরদস্তি করার চেষ্টা করে। পাড়ার লোকে অনিন্দ্যদাকে ধরে ফেলে এবং পুলিশে দেবার হুমকিও দেয়। অনিন্দ্যদার বাবা ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বদলি নিয়ে ওখান থেকে চলে যায়। আমি ভেবেছিলাম ওর চ্যাপ্টার চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে আমার জীবনে কিন্তু সেদিন যখন আবার তোমার সাথে ওকে দেখলাম আমি অত্যন্ত অসহায় হয়ে পরেছিলাম। ভাবলাম তোমাকে সব জানায় কিন্তু আবার পরমুহূর্তেই ভাবলাম যদি তুমি ভুল বোঝো আমাকে।"
-" এই সত্যিটা তুমি আমাকে আগে জানালে না কেনো? "
-" বললে তুমি বিশ্বাস করতে? তাই আমি নিরব হয়েই তোমার জীবন থেকে চলে আসি আর তাছাড়া তুমিতো আমায় ভালবাসনা। শুধু বন্ধুত্বের সম্পর্কে তো সারাজীবন চলে না পল্লব। তুমি আরেকটা বিয়ে করো। সুখী হও"
-" আমার সুখ যে তোমাকে ঘিরেই সুরভি। এই কদিন তোমার অনুপস্থিতি আমার জীবনটাকে একলা করে দিয়েছে। আমি আজ উপলব্ধি করেছি সেই শূন্যতা শুধুমাত্র একজন বন্ধুর জন্য নয়, সেটা ভালবাসার মানুষের জন্য। আমি তোমার ভালবেসে ফেলেছি, চল ফিরে চলো আমার সাথে"
-" যেদিন অনিন্দ্যদা ফিরে এলো সেদিন থেকে আমিও তোমারকে হারিয়ে ফেলার ভয় অনুভব করেছি। বুঝেছি এই ভয় শুধুমাত্র বন্ধুত্ব হারিয়ে ফেলার নয়, তোমার সাথে থাকতে থাকতে তুমি আমার নিশ্বাসে বাঁধা পরে গেছো। আমিও তোমায় ভালবাসি। ভেবেছিলাম ভালবেসে তোমায় নিভৃত যতনে, সযত্নে লুকিয়ে রাখব আমার মনের মন্দিরে কিন্তু বাস্তবে তার আর হলো কই?"
-" এখনো দেরী হয়নি কিছু, চলো আবার নতুন করে সব শুরু করব"
-" যে বিশ্বাস একবার ভেঙে যায় সেটা জোড়া লাগলেও ভাঙার একটা দাগ থেকেই যায়। মানুষের সম্পর্ক ভাঙার দাগ মোছার জন্য অনেকটা সময় দরকার পরে। সংসার এতো সরল না পল্লব। আমার মনে তোমার যে সম্মানের জায়গাটা ছিল সেটার ভীত এখনো টলমল করছে। আমি কল্যাণীতে একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছি। কালই চলে যাবো। কিছুদিন আমি নিজের সাথে সময় কাটাতে চাই পল্লব। আমিত্বটা খুঁজে পেতে চায়। আমার কিছুদিন সময় চায়, জানিনা সেই সময়টা হয়তো একদিনও হতে পারে আবার সারাজীবনও। যেদিন মনে হবে তোমার প্রতি ভরসার জায়গাটা ফিরে পেয়েছি, সেদিন আবার ফিরে আসব। তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে পারবে?"
-" পারব সুরভি, আমি পারব। আমি জানি তুমি একদিন আমার কাছে ফিরে আসবেই। যে দোষ আমি করেছি, যে ক্ষত আমি তোমায় দিয়েছি সে ক্ষতপূরণের একমাত্র ওষুধ হলো সময়। যাও মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলো আকাশ, আজ আর কেউ আটকাবে না তোমাকে"

অচিরেই বিধাতা মুচকি হেসে গেয়ে উঠলেন-

"মনে ক'রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী-- তোমার
কনককঙ্কণে॥
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো-- তোমার
অলকবন্ধনে।"

-সমাপ্ত-



Our others topics:


Post a Comment

0 Comments